সান্ডা নিয়ে কিছু কথা
"সান্ডা" আসলে কী? আরব দেশেএই প্রাণী খাওয়ার ইতিহাস কত বছর আগের।
সান্ডা খাওয়া হারাম নয়, বরং হালাল। ইসলামে হালাল ও হারামের সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। তবে কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলো সরাসরি কুরআন-হাদীসে উল্লেখ না থাকায় আলেমগণ ফিকহি বিশ্লেষণের মাধ্যমে তার বিধান নির্ধারণ করেন। তেমনই একটি বিষয় হলো সান্ডা খাওয়া।
আবাসস্থল ও জীবনধারা: এই টিকটিকিগুলো মূলত মরুভূমি, পাথুরে এলাকা ও শুকনো তৃণভূমিতে বাস করে। এরা দিনের বেলায় সক্রিয় থাকে (দিবাচর) এবং তীব্র গরম থেকে বাঁচতে গর্ত তৈরি করে বা পাথরের ফাটলে আশ্রয় নেয়। কাঁটা লেজবিশিষ্ট টিকটিকি তৃণভোজী প্রাণী। এদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে বিভিন্ন ধরনের লতাপাতা, ফুল, ফল ও বীজ। এরা খুব কম পানি পান করে। এরা খাবারের মাধ্যমেই প্রয়োজনীয় পানি গ্রহণ করে।
ইসলামী শরীয়তের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস হলো কুরআন ও সুন্নাহ। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জীবনে সান্ডা খাওয়া নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা রয়েছে।
একবার নবী করিম (সা.)-এর সামনে সান্ডা পরিবেশন করা হয়। তিনি সেটা খাননি। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, "ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কি এটি খেতে অপছন্দ করেন, না কি এটি হারাম?"
অর্থাৎ, তিনি নিজে না খেলেও সাহাবীদের খেতে মানা করেননি। এমনকি সাহাবীগণ তার সামনে তা খেয়েছেন।
ফিকহবিদগণ এই হাদীসগুলো বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন মাযহাবে সান্ডা খাওয়ার হুকুম নির্ধারণ করেছেন।
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেছেন: সান্ডা খাওয়া মাকরূহ তাহরিমি। অর্থাৎ, না খাওয়াই উত্তম।
কারণ: এটা অরুচিকর প্রাণী, মানুষ সাধারণত খেতে চায় না।
এসব মাযহাবের আলেমদের মতে, সান্ডা খাওয়া পুরোপুরি হালাল।
হাদীস অনুযায়ী, নবী (সা.) নিষেধ করেননি, তাই এটা নিষিদ্ধ নয়।
বহু দেশে সান্ডা তেলের চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় এবং যৌন স্বাস্থ্য বৃদ্ধির উপাদান হিসেবে সান্ডা তেল ব্যবহার করা হয়। যদিও আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে এটির কার্যকারিতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক ও খাদ্যাভ্যাস: ঐতিহ্যগতভাবে মধ্যপ্রাচ্যের কিছু যাযাবর গোষ্ঠী কাঁটাযুক্ত লেজবিশিষ্ট টিকটিকিকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। বিশেষ করে আরব উপদ্বীপের অভ্যন্তর ও পূর্বাঞ্চলে এদের ‘ধাব্ব’ নামে ডাকা হয়। একসময় আরবদের মধ্যে উপাদেয় খাবার হিসেবে বিবেচিত হতো।
আরবদের টিকটিকি খাওয়ার ঐতিহাসিক দলিল: ২০১৪ সালের মার্চে এনবিসি নিউজে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, নতুন গবেষণা অনুযায়ী, সৌদি আরবে মধ্যযুগে মরুভূমিতে বসবাসকারী আরবরা ইসলাম ধর্ম আবির্ভাবের পরেও টিকটিকি খেতেন।
ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক গ্রন্থগুলোতে এই আঁশযুক্ত মরুভূমির খাবারটির উল্লেখ রয়েছে। এই আবিষ্কারই প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ। গবেষণাটির সহলেখক এবং প্যারিসের সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ের জু-আর্কিওলজিস্ট হার্ভে মনচোট লাইভ সায়েন্সকে এ তথ্য জানিয়েছিলেন।
মনচোট বলেন, টিকটিকি সম্ভবত খাওয়া হতো, কারণ এটি ‘প্রোটিনের একটি চমৎকার উৎস’।
মনচোট ও তাঁর সহকর্মীরা সৌদি আরবের মরুভূমিতে আল-ইয়ামামা নামক একটি মরূদ্যান খনন করার সময় এর প্রমাণ খুঁজে পান। স্থানটি খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত জনবসতিপূর্ণ ছিল। একটি বৃহৎ মসজিদ কমপ্লেক্সের অংশ এই স্থানে উট ও ছাগলের হাড়ে পূর্ণ খাদ্য বর্জ্যের স্তর পাওয়া গেছে।
হাড়ের স্তূপগুলোতে টিকটিকির ১৪৫টি কঙ্কালের অবশিষ্টাংশও ছিল। এই অঞ্চলের মরুভূমিতে বসবাসকারী লোকেরা সম্ভবত কমপক্ষে ২ হাজার বছর ধরে একই পদ্ধতিতে এই প্রাণী শিকার করে খেয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনটি অনলাইন জার্নাল অব আর্কিওলজিক্যাল সায়েন্সে প্রকাশিত হয়েছে।
তবে, বর্তমানে বন্য পরিবেশে এদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় এবং কিছু অঞ্চলে এদের ধরা ও বিক্রি করার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ থাকায় খাদ্য হিসেবে এদের ব্যবহার সীমিত হয়ে এসেছে। তা ছাড়া, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষার গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন এদের ধরা ও খাওয়ায় নিরুৎসাহিত করা হয়।
গুরুত্ব ও সংরক্ষণ: কাঁটাযুক্ত লেজবিশিষ্ট টিকটিকি মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমির বাস্তুতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তৃণভোজী হওয়ায় এরা উদ্ভিদের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। তবে, আবাসস্থল ধ্বংস, অতিরিক্ত শিকার এবং পোষা প্রাণী হিসেবে অবৈধ বাণিজ্য এগুলোর অস্তিত্ব হুমকির মুখে ফেলেছে।
এই জাতের টিকটিকি কেবল মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমির একটি বিশেষ প্রাণীই নয়, এটি এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্যেরও প্রতীক।
তাহলে সান্ডা খাওয়া কি জায়েজ?
দিক | ব্যাখ্যা |
কুরআন | সরাসরি কোনো উল্লেখ নেই। |
হাদীস | রাসূল (সা.) নিজে খাননি, তবে নিষেধও করেননি। সাহাবারা তার সামনে খেয়েছেন। |
হানাফি মাযহাব | মাকরূহ (না খাওয়াই ভালো)। |
অন্য মাযহাব | হালাল ও জায়েজ। |
চিকিৎসা ও ব্যবহার | তেল ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তবে নিশ্চিত প্রমাণ সীমিত। |
মন্তব্যসমূহ